Tuesday, January 24, 2012

দিন-বণিক: স্টল নাম্বার ১৩২

আজকের হাওয়াটা ভালো আছে।
বেশ একটু রোদ উঠেছে।
এরকম ওয়েদারে নানাবাড়ি ঘুরতে যেতে মন চায়।
স্কুলের ডিসেম্বরের ছুটির কথা মনে হয়।

এরকম সময়ে পাবনায় যেতাম। আর খেলতাম ব্যাডমিন্টন। আহ! ছাদে পিকনিক করাও একটা মজা ছিল। ছোট্ট মাটির চুলায় রান্না। এক একজনের মাথার উস্কোখুস্কো চুল বাতাসে উড়ছে, মা-খালারা ক্রমাগত বকাবকি করছে  পালা করে, কিন্তু পাত্তা দেয় কে! রান্না শেষে মামা সুন্দর করে এসে বলত, 'কি রে, তোরা কি একাই খাচ্ছিস নাকি? আমাদেরকে দিবি না?' শেষে নানাজীকে একটা বাটিতে করে একটু, মামাদেরকে, পিচ্চিরা আর আমরা.... কিন্তু কিভাবে যেন সবারই হয়ে যেত!

আহ! ভাবতে একটা কষ্ট কষ্ট ফিলিংস হয়। এখন আর নানী নাই। রান্নাঘরে সারাক্ষণ ভাত ফুটতে থাকে না। অদ্ভুত পাবনার ভাষায় বকাবাজি করারও কেউ নাই। সেই নিচতলা থেকে চাপকলের পানি টেনে উঠাতে হয় না। টানা লম্বা বারান্দাটাও নাই। সব মামাদের জন্য আলাদা আলাদা রান্নাঘর, আলাদা বারান্দা। বাড়িটাতে পা রেখেই মনের আনন্দটা চট করে নিভে যায়।

হয়ত এটা মানুষের মনের অদ্ভুত কোন ব্যাপার। ঐ বাড়িটার সাথে শৈশবের আনন্দগুলো জড়িয়ে গেছে। যদিও এখন আর বাড়িটাও আগের মত নেই, তার বাসিন্দারাও বদলেছে, তবু ঢাকার দমবন্ধ পরিবেশে থাকতে থাকতে যখন হাঁপিয়ে উঠি, তখন মনটা দৌড় মারে ঐদিকে। ঢাকার উপর ভালবাসার সিলিং নাই। এজন্য ঢাকায় সারাজীবন কাটিয়েও ঢাকার উপর টান সহজে হতে চায় না।
শুধু মনে হয় ঐখানটাতে সুখ রাখা আছে।
বস্তা বস্তা সুখ.........

আসলে হয়ত এখন আর নাই..........
কিন্তু মানুষের মায়া কাটতে প্রচুর সময় লাগে।

এজন্য এখনো যখন শীত পড়ে, রাস্তার পাশে মাটির চুলা থেকে ভাঁপা পিঠার ঘ্রাণ ওঠে, তখনই চোখ বন্ধ করে আমি ক্লাস ফোরের ছাত্রী হয়ে যাই।
রাতদিন উবু হয়ে বসে ছবি আঁকি। স্কিপিং খেলি। ব্যাডমিন্টন খেলি। আর হলুদ প্রজাপতির পিছনে ছুটে হাঁটু ছুলে ফেলি। কিন্তু ধরার পর যখন তার ডানার হলুদ রং হাতে উঠে এল তখনই মনটা এত খারাপ হল যে বলার মত না। প্রজাপতিটা আর উড়তে পারছে না.... কী করা যায়? দুই তিনটা পাতা দিয়ে একটা প্রজাপতির ঘর বানানো হল, সেই ঘর তুলে দিলাম পেয়ারা গাছের ডালে। যদি ও সুস্থ হয় তো উড়ে যাবে। আমার আর মেজ আপুর দুশ্চিন্তার শেষ নেই। আম্মু এদিকে ডাকাডাকি করছে...... দুপুরের ভাত এক দৌড়ে খেয়ে ফিরে এসে দেখি প্রজাপতিটা আর নেই!
একই সাথে আনন্দ আর দু:খ মিশানো একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল.....
হয়ত মনে মনে আশা করেছিলাম, প্রজাপতিটা পুষব......

............................................


বেশ কতগুলো দিন ছুটি পাওয়া গেল। ফ্রেন্ডদের সাথে দেখা হল না। কেবল অলস বসে থাকলাম। এটারও একটা আনন্দ আছে।
বাণিজ্যমেলায় গেলাম। বাংলাদেশীরা কত বোকা তা দেখে অবাক লাগে। গত চার-পাঁচ বছর ধরে বাণিজ্যমেলায় একই জিনিস বিক্রি হচ্ছে। প্রথমদিকে জেনুইন জিনিস বিক্রি হত। এবার দেখলাম, ইরানী কার্পেট নাম দিয়ে মালয়েশিয়ান কার্পেট(যেটা কিনা তাকিয়েই বোঝা যায়। ইরানী কার্পেটের সেই সব সুক্ষ্ম নকশা-টকশা কিছুই নেই। ) দেদারসে বিক্রি হচ্ছে। আর সেইসব লকেট আর নকল পাথর..... পাঁচ সাতশ দামের জিনিস হাজার দেড় হাজারে বিক্রি। বিজনেসম্যানরা সবাই কি ধাপ্পাবাজ? দেশ বিদেশ নাই। এরা একই ধর্মের। এদের ধর্ম হল ব্যাবসা। আর কিছু না। সাথে করে দেখলাম কিছু সুন্দর সুন্দর সেলসগার্ল আর সেলসম্যান নিয়ে এসেছে, এদেরকে সাজিয়ে গুজিয়ে বসিয়ে রেখেছে। আগে মেলায় গিয়ে এটা সেটা কিনতাম। ঘুরতাম। মানুষ দেখতাম। এবার মারাত্মক বিরক্তি কাজ করল। কিভাবে মানুষকে ঠকাচ্ছে। আর মানুষও জেনে শুনে ঠকছে। সুন্দর পাকিস্তানী, ইন্ডিয়ান, ইরানী, মরক্কান চেহারা দেখার বিনিময়ে টাকা দিয়ে পুরান ঢাকার সিলভার প্লেটেড গহনা কিনে একে ওকে গিফট করছে। হায়রে মানুষ!
আমাদের দেশের লোকগুলো আসলে গাধা টাইপের। নাহলে সারা দুনিয়ার মানুষ শাসন করার জন্য, শোষণ করার জন্য, ব্যাবসা করার জন্য এখানে ভেঙে পড়ে কেন?
আমরা গাধা তো বটেই।
ভদ্র গাধা।
আবার সারা দুনিয়ার মানুষের মেহমানদারী করি।
আজব!

.............................


খুব জরুরী একটা কাজ করার কথা কিন্তু ফেলে রেখেছি। করা হবে তো?
হতেই হবে। নাহলে হবে না।

ভাবছি একটু গিটারটা নিয়েও বসব। বহুদিন বসা হয় না। বেচারী গিটারটা। ধুলা জমে গেছে।

আজকাল তেমন কিছু লিখতে পারি না। আসে না। না এলে কী করা!

কেমন যেন একটা স্থবিরতার ধুলো জমেছে মনে। যা কিছু করছি কিছু গায়ে লাগছে না। মনে হচ্ছে স্বপ্নের (নাকি দু:স্বপ্নের) ঘোরে বেঁচে আছি। জীবনের কোন লক্ষ্য-উদ্দেশ্য টের পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে এই ২০১২ তে এসে জীবনটা গতিশীল সাম্যাবস্থার প্যাঁচে পড়ে গেছে। equilibrium. যতটুকু ভাঙছে, ততটুকু গড়ছে।
অথবা
গতিশীল স্থিতি। ভার্সিটি যাচ্ছি, ক্লাস করছি। ভার্সিটির ক্লাসমেটদের সাথে মিশছি। গল্প করছি। হাসাহাসি করছি। কিন্তু আসলে আমি অন্য কোথাও আটকে আছি।
কোথায় আটকে আছি?
এটা আমি নিজেও জানি না।


জানার চেষ্টাও করছি না।


অতীত নিয়ে আর ভাবি না। চলে গেছে তো ব্যাটা.....
বর্তমান? চলছে আরকি.......
ভবিষ্যৎ নিয়েও ভাবছি না....... ভাববার কিছু নেই তো....

জীবনানন্দের সুচেতনার মত,

"সুচেতনা তুমি এক দূরতর দ্বীপে....." এর পরের লাইনটা কেন যেন মনে থাকে না ।

আরেকটা আছে না? ঐ যে, কি জানি নাম কবিতাটার?

"এইখানে সরোজিনী শুয়ে আছে,
  জানি না সে এইখানে শুয়ে আছে কিনা....."

একটু পালায় যাইতে পারলে ভালো হইত..............

জীবনটা একটা চক্রের মধ্যে বাঁধা পড়ে গেছে। ক্লাস-বাসা-পরীক্ষা-ছুটি-ছুটিতে কিছু না করা-আবার ক্লাস শুরু হওয়া-খারাপ ওয়েদার-রাজনৈতিক পরিস্থিতি-কারেন্ট নাই-পানি নাই-লাইফের উপর কন্ট্রোল নাই.............. একই কেচ্ছা ঘুরে ফিরে।
আর ভালো লাগতেসে না।
জীবনটা একগ্লাস রঙিন পানি হইলে একটা চামচ দিয়ে জোরে নাড়া দিয়া দিতাম।

ব্যাটা বজ্জাত, তুই রঙিন পানি হইলি না ক্যান?

একটা দিনের ক্ষুদ্রাংশের জন্যও যদি সেই ক্লাস ফোরের ফ্রকপরা বাচ্চা মেয়ে হওয়া যেত.............
ডানা ছাড়া প্রজাপতির মত সারাটাদিন উড়ু উড়ু ভাবে খেলে বেড়াতে পারতাম......

এখনকার বত্রিশটা দিন মিলেও ঐসব দিনগুলোর একটা ঘন্টার সমান হয় না.......
হলে ট্রেড করে নিতাম.....
বাণিজ্যমেলায় একটা স্টল দিতাম। উপরে সুন্দর করে লেখা থাকত "দিন বণিক" স্টল নাম্বার ১৩২।
ভাঙারির দোকানের মত মানুষ সেখানে তাদের ভাঙাচোরা নষ্ট হয়ে যাওয়া সময়টুকুর বিনিময়ে সলিড আনন্দ কিনে নিয়ে যেত।


আসত ভাঙা বুকে, আর ফিরত মহা সুখে........

 আফটার অল, জীবনের খুব অল্প ক'টা দিনই আমাদের খুব সুন্দর কাটে। বাকি দিনগুলোর বিনিময়ে সেই দিনগুলো পাওয়া খুব সস্তা কথা না।

......................

 [বাই দ্য ওয়ে, পেইন্টিংটা Gustav Klimt এর Tree of Life. দিয়া দিলাম। একটু দেখেন আর কি। লেখায় বিশেষ কিছু যেহেতু নাই, অন্তত একটা ভালো ছবি থাকল।]

2 comments:

  1. ছবিটা খুব বোরিং টাইপের লাগলো। ভ্যাদভ্যাদা একটার রং লেপেটে আছে পুরা জায়গাটাতে। কী কী অবজেক্ট আছে -- তাও ঠাওর করতে পারলাম না।

    তবে লেখাটা মজার ছিলো। ডাইনামিক ইকুইলিব্রিয়াম এর জায়গাটা। ভাঙ্গাগড়া আর রঙ্গিন গ্লাসের ফিলোসফিটা। কিছু স্মৃতিচারণ -- এই সবকিছু মিলে আমার শতবর্ষের আটকে থাকাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এদিক ওদিক না নড়া জীবনের অসুস্থকাব্য আমার।

    দিনবণিক আইডিয়াটা সুন্দর। তবে, আমি বোধহয় কোনদিনই ওই দোকানে যেতাম না

    ReplyDelete
  2. ছবির ব্যাপারে: বোঝা গেল আপনি চিত্রকলা মোটেও বোঝেন না অথবা ছবি ঠিকমত দেখেনই নাই অথবা ছবিটা বড় করে দেখেন নাই তাই বোঝেন নাই। কারণ আমার তো মনে হয় এই ছবি এতই ক্লিয়ার কাট স্টাইলে আঁকা এটার অবজেক্ট বুঝতে না পারাটাই অসম্ভব।

    লেখার প্রসংশার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। হুমম... ফিলসফিটা কয়েকদিন না বহুদিন ধরে মাথায় ঘুরছিল, শেষমেষ লিখেই ফেললাম। :)

    ঠিক আছে, আপনি নাহয় না-ই আসলেন আমার দোকানে :D আরো অনেকে আসবে... আমি tv তেও Advertise করব দেখবেন।

    ReplyDelete

What do you think?