Wednesday, May 29, 2013

অ্যাহ মেয়েরা, চুপ ক্যারা.....


আমাদের নিরঞ্জন স্যার, স্কুলের অংক স্যারের কথা হঠাৎ খুব মনে পড়ছে। স্যার বেশ কিছুটা অদ্ভুত ছিলেন, এই হিসেবে যে স্যারের কোনই বিশেষত্ব ছিল না, অংক করতে পারা ছাড়া।

স্যারের ক্লাসে আমার কাজই ছিল গল্প করা। ক্লাসটা হত খুবই বোরিং, স্যার এসে ঢুকতেন, চক হাতে নিতেন,বোর্ডে যেতেন এবং কোন ভুমিকা ছাড়াই অংক করানো শুরু করে দিতেন। আমি একহাতে স্যারের অংক তুলতাম, অন্যহাতে ফ্রেন্ডের সাথে খোঁচাখুঁচি করতাম আর মুখ দিয়ে সমানে কথা বলে যেতাম। যখন বেশি কথার শব্দ হত,স্যার হঠাৎ হঠাৎ পিছন ফিরে একটা হাঁক দিতেন,'অ্যাহ মেয়েরা,চুপ ক্যারা....'

মানে আসলে এটা ভ্যাঙানোর জন্য মনোযোগ দিয়ে স্যারের কথা শুনতে গিয়ে আমি আবিষ্কার করেছিলাম যে স্যার কিছু কিছু উচ্চারণ করে খুবই অদ্ভুত। আমার বান্ধবীর সাথে এনিয়ে আমার তর্ক লেগেছিল- ও শুনত স্যার বলে 'থেইকা' (মানে থেকে) আমি শুনতাম 'থেকিয়া' শেষে আমার কথাই ঠিক প্রমাণ হল। সেদিন আমার আনন্দ....... আহ!!
স্যার আরও বলত,'লও' মানে সাধু ভাষা আর কি!
স্যারের সবচেয়ে মজার কাজটা ছিল তার হাঁচি। একবার শুরু হলে আর থামতেই চাইত না।আসলে লিখতে লিখতে কোনক্রমে যদি নাকের ভিতর চকের গুঁড়ো ঢুকে যেত তখন শুরু হত স্যারের হাঁচি। ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে গিয়ে মুখটা আড়াল করে স্যার প্রচন্ড জোরে হাঁচতে থাকত, আর আমরা হাসতে থাকতাম! বসে বসে গুনতাম কয়টা হাঁচি দেয় স্যার। স্যারের সর্বোচ্চ রেকর্ড তখন পর্যন্ত ছিল ৮ টা।
স্যারের হাতের লেখা এত দ্রুত আর এতই বাজে ছিল যে আমরা কিছুতেই তাল রাখতে পারতাম না। অংক ক্লাসের পর হাত ব্যথা করত। এখন মনে হয়- 'তাহলে স্যারের কত হাত ব্যথা হত?'
ছোটখাট সাইজের মানুষ, মগজে অংক ধরত না দেখেই বোধহয় স্যারের পেটের মধ্যেও অংক জমা থাকত! স্যার হাসতেন না, মানে হাসতেন খুবই কম। আমি স্যারকে তিনবার হাসতে দেখেছিলাম। একবার কম্পিউটার ম্যাডামের (কমলা পরী) সাথে হেভি ভাবের সাথে গল্প করার সময়, আরেকবার কি একটা পড়াশুনার কথা বলে স্যার খুব হেসেছিল, তৃতীয়বারও কি একটা পড়ার কথা বলে হেসেছিল। কমলা পরীর কথা স্যারের মেয়েকে বলে দেবার পরিকল্পনা করেছিলাম আমরা ফ্রেন্ডরা, যাতে স্যার আমাদের অংকে বেশি নাম্বার দেয়।

বেশ কিছুদিন আগে স্কুলে গিয়েছিলাম। অনেক টীচার একেবারেই চিনতে পারেননি। আসলে যাকে দেখতে গিয়েছিলাম, তার কাছেই পাত্তা পাইনি। অথচ যারা চিনত বলেই মনে হত না তারাই খুব উৎসাহের সাথে কথা বলল। আমি আর আমার ফ্রেন্ড খুব অবাক হয়েছিলাম ব্যাপারটায়। সবচেয়ে অবাক লেগেছিল নিরঞ্জন স্যার চিনতে পেরেছে দেখে!! অথচ যাদের চেনার কথা তারা চেনেইনি! স্যার খুব সদয়ভাবে হেসে আমাদের সাথে কথা বললেন। স্যার যে বোর্ড ছাড়া আর কিছু চেনেন এটা বিশ্বাসই হতে চায় না!


আমি স্যারের এই ছবিটা এঁকেছিলাম ক্লাস টেনে থাকতে। জ্যামিতিক চিত্র। এমনকি স্যারের মাথার আচিলটাও বাদ রাখিনি! ক্লাসে বোর্ডে যখন ছবিটা এঁকে সবাইকে দেখিয়েছিলাম, প্রচন্ড হেসেছিল সবাই।

এখন স্যারের জন্য খারাপ লাগে। মনে হয় স্যার এখনও তার মেয়ের ব্যাগটা বয়ে নিয়ে আসে হয়ত।এখনও আগের মতই বড় হাতার শার্ট পরে। আমার মতই অনেক ছাত্রীই হয়ত স্যারকে নিয়ে হাসে, ব্ল্যাকমেইল করার চিন্তা করে। স্যার এখনও নিশ্চয়ই আগের মতই হাঁচি দেয় আর মেয়েরা হাসে। স্যারের সারা জীবনটা এভাবেই কেটে যাবে, অংক করিয়ে।
কোন পরিবর্তন নেই, চূড়ান্ত একঘেয়ে। বছর বছর একই অংক বোর্ডে করানো, নিশ্চয়ই খুব বিরক্তিকর ব্যাপার।

কেমন যেন খারাপ লাগে। মায়া হয়। বেচারী স্যার!!!!!

.................................
[এই লেখা সামহয়্যারইন ব্লগে ০৭ই অক্টোবর ২০০৭ সন্ধ্যা ৬:২০ এ পোস্টেড। এখানে রিপোস্ট করলাম।]

1 comment:

  1. কোন পরিবর্তন নেই, চূড়ান্ত একঘেয়ে। বছর বছর একই অংক বোর্ডে করানো, নিশ্চয়ই খুব বিরক্তিকর ব্যাপার। কেমন যেন খারাপ লাগে। মায়া হয়। বেচারী স্যার!!!!!

    ReplyDelete

What do you think?